সিরিয়ালের জন্য বাড়তি টাকা না দিলে সারা রাত ফেরি পারের অপেক্ষায় ট্রাক ও গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে হয় চালকদের। কাঁচামাল ও পচনশীল পণ্যবাহী যানগুলো দ্রুত পারাপারের কথা থাকলেও মানা হচ্ছে না সেই নিয়ম।
এ চিত্র শরীয়তপুরের জাজিরা-শিমুলিয়া নৌপথের সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ফেরিঘাটে। ওই পথে রাতে চলাচলকারী পণ্যবাহী গাড়ি থেকে সিরিয়ালের বিনিময়ে ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতায় টাকা তুলছে স্থানীয় একটি চক্র।
তবে পুলিশ বলছে, অভিযোগের সত্যতা মিললে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাদারীপুরের বাংলাবাজার থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে গত বছর তীব্র স্রোতের টানে পদ্মা সেতুর পিলারের সঙ্গে রো রো ফেরির একাধিকবার ধাক্কা লাগে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ১৮ আগস্ট থেকে ওই নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তখন থেকে শরীয়তপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের চলাচলের জন্য ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাট এলাকায় নতুন একটি ফেরিঘাট নির্মাণ করা হয়। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে ওই নৌপথে ফেরি চলাচল শুরু হয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডাব্লিউটিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে ওই নৌপথে দিনের বেলায় তিনটি এ-টাইপের ফেরি, দুটি ডাম্প ফেরি ও একটি ছোট ফেরি চলাচল করছে। রাতে শুধু তিনটি এ-টাইপের ফেরি চলছে। রাতের বেলায় ডাম্প ফেরি দুটি ও ছোট ফেরি বন্ধ রাখা হয়। দিন-রাত মিলিয়ে নৌপথটিতে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে।
রাতে সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাট দিয়ে ২০০-২৫০টি পণ্যবাহী ট্রাক পার হয়। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এ ঘাটে পণ্যবাহী ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ অনেক বেড়েছে। ঢাকাগামী কাঁচামালবাহী ট্রাকগুলো সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাটে আসা শুরু করে সন্ধ্যার পর।
যেহেতু এই পথে ফেরি কম তাই অল্প সময়েই ঘাটে গাড়ির জটলা লেগে যায়। তখন সড়কে দীর্ঘ সারিতে পারাপারের জন্য গাড়িচালকদের অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই সুযোগ কাজে লাগায় স্থানীয় শহীদ চেংগা নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি চক্র। তারা পণ্যবাহী গাড়ি ফেরিতে আগে তুলে দেওয়ার কথা বলে গাড়িপ্রতি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা নেয়।
টাকা পাওয়ার পর রং সাইড দিয়ে ওই গাড়িগুলো ফেরিঘাটের দিকে পাঠানো হয়। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ওই গাড়িগুলো ফেরিতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন ব্যক্তিগত গাড়ি দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়।
কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ও প্রতিবাদ করলে তাঁদের মারধর করা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাত্তার মাতবর-মঙ্গল মাঝির ঘাটে আসা পণ্যবাহী ট্রাক থেকে টাকা তুলছিলেন শহীদ চেংগা। এ সময় সিরিয়াল ভেঙে ফেরিঘাটের দিকে গাড়ি পাঠানোর প্রতিবাদ করেন তারেক মাদবর নামের এক চালক।
তখন শহীদ ও তাঁর লোকজন ওই চালককে মারধর করেন। তারেক মাদবর বলেন, ‘আমরা গাড়ি নিয়ে ফেরিতে ওঠার জন্য সিরিয়ালে অপেক্ষা করছিলাম। শহীদ টাকা নিয়ে সিরিয়াল ভেঙে গাড়ি ছাড়ছিলেন। আমি এর প্রতিবাদ করি। তখন চার-পাঁচজন মিলে আমাকে মরধর করে। ’
জরুরি কাঁচামালবাহী গাড়ির চালক আতাউর রহমান বলেন, টাকা নিয়ে শহীদ চেংগা যেসব গাড়ি সামনের দিকে পাঠান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা সেগুলোকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ করে দেয়। এ বিষয়ে কোনো চালক প্রতিবাদ করলেই তাঁকে মারধর করা হয়।
অভিযোগ অস্বীকার করে শহীদ চেংগা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি কোনো গাড়ি থেকে টাকা তুলছি না। আমাদের সড়কটি সরু। অনেক সময় দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে গিয়ে যানজট লেগে যায়। তখন অনেককে সহায়তা করি। এ জন্য কারো কাছ থেকে টাকা নেই না। ’
রমিজ উদ্দিন, আলম মিয়া, চান শরীফসহ একাধিক চালক বলেন, ‘রাতে ফেরিঘাটে গাড়ির চাপ বেশি থাকে। আমরা অনেকেই বাজার ধরার জন্য আগে যাওয়ার চেষ্টা করি। এ জন্য শহীদের মাধ্যমে পুলিশকে টাকা দিই। টাকা না দিলে রাত শেষ হয়ে গেলেও ফেরি পার হওয়া যায় না। ’
ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতায় চাঁদাবাজি হচ্ছে এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ঘাটে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক আরিফুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। থানা-পুলিশকে জানানো হয়েছে। ’
আরিফুর রহমান বলেন, ‘ফেরিঘাটে ট্রাফিক পুলিশের ১০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে একজন টাউন ইন্সপেক্টর, চারজন সার্জেন্ট ও চারজন কনস্টেবল আছেন। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া) সার্কেল এস এম মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। সুত্রঃ কালেরকন্ঠ