কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায়-
কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত,
রাখালেরা পুনর্বার বাশিঁতে আঙুল রেখে
রাখালিয়া বাজাবে বিশদ
সারা পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম করোনা। খালি চোখে দৃশ্যমান নয়, এমন একটা ভাইরাস সারা বিশ্বের চেহারা পাল্টে দিয়েছে রাতারাতি। মানুষকে অনেকদিন ঘরবন্দী করে রেখেছিলো। বর্তমানে আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার নতুন করে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, করোনা ভাইরাস মানবজাতিকে পরীক্ষার উপর রেখেছে। সেই সঙ্গে মানুষকেও অনেক কিছু উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। করোনা আমাদের একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমাদের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য যে কতটা প্রকট। পাশাপাশি এটাও দেখিয়ে দিল, আমাদের মানসিকতার বিস্তর ফারাক।
করোনা আমাদের মধ্যে ইন্টার পারসোনাল রিলেশন বাড়িয়েছে, আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে একে অপরকে ভালোভাবে বুঝার, চেনার। করোনা আমাদের আরো বেশি করে সামাজিক করে তোলার সুযোগ দিয়েছিলো। কিন্তু আমরা কতটা সামাজিক হতে পেরেছি?
এসময় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক ভালোবাসায় বন্ধন দৃঢ় হওয়ার কথা। বর্তমান টেকনোলজি আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে দূরে থেকেও কাছে থাকার। বিপদে বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। কথাটা বহুল প্রচলিত। পরিবারের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা বেড়েছে।
আমরা আমাদের বয়স্ক বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজনদেরকে সহজে এলাও করছি না বাড়ির বাইরে যেতে। আমরা আত্মীয়-স্বজনকে বলছি সচেতন থাকতে। এ করোনাকালে অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ সব বন্ধ থাকাতে সকলেই অল্প-বিস্তর অবসর সময় পেয়েছে, যেটা পরিবারের সঙ্গে কাটানোর একটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। সেটা কতোটুকু কাজে লাগাতে পারলাম আমরা?
জীবন চলার পথে অনেক শত্রুর দেখা মেলে। তাদের কেউ দৃশ্যমান আর অনেক কিছুই থাকে দৃশ্যহীন। মানব আর বস্তু দুটুই থাকে এতে। থাকে আত্মীয় স্বজন ও কাছের মানুষও। আরও অনেকেই। এদের থেকে সতর্কভাবে সাবধানে চলতে হয়। এদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসাও করতে হয় এসব শত্রুদের। করোনার এই কঠিন সময়েও মন বদলায়নি তাদের। চরিত্রও রয়ে গেছে আগের মতই। প্রকৃতিই তাদের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করে। করোনার ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি তারা।
চীনা সমর বিজ্ঞানী সান জু তাঁর পৃথিবী-বিখ্যাত বই ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’-এ লিখেছিলেন, জয়লাভের জন্য শত্রুকে সঠিকভাবে জানা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। এই যে করোনাভাইরাসের আকস্মিক আক্রমণ, আমরা আজও আমাদের এই ভয়াবহ শত্রুকে সম্পূর্ণ জানতে পারিনি।
এই গণশত্রু থেকে সামান্যতম শিক্ষা নিয়েও যদি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সঠিক দিক-নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হতে পারি সেটাতেই আমাদের সফলতা আসবে।
বিল গেটসের মতে, করোনা আমাদের দেখিয়েছে যে, আমারা সবাই একে অপরের সঙ্গে দারুণভাবে সম্পৃক্ত। জগতের সব কিছুই একটি বন্ধনে আবদ্ধ। সীমান্তরেখাগুলো আসলেই মিথ্যা। এই ভাইরাস আসলে বুঝিয়ে দিয়েছে, জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। যেকোনো সময় জীবনের ইতি টানতে হতে পারে।
বিল গেটসও মনে করেন, এই করোনাভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে নিজের পরিবার আর আপন জনকে আমরা কতোটুকু অবহেলা করি। এ ভাইরাস প্রিয়জনদের সঙ্গে আমাদের নতুন করে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ তৈরি করে দিলেও আমরা অনেকেই এখনও তা করতে পারি নাই।
করোনাভাইরাস মনে করিয়ে দেয়, কঠিন সময়ের পরেই আসে সুন্দর সময়। জীবন একটা চক্রের মতো। এটি আপন মনে ঘুরবে। করোনা এই দুঃসময়টি হলো ওই চক্রের একটি পর্ব। আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই, এই পর্বও চলে যাবে ইনশাআল্লাহ ।
করোনাকালীন সময়ে আমাদের ধর্মীয় সচেতনতা বেড়েছে বহুগুণ। বাবা মা ও নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বিদায়, করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল, চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টার পরও রোগীর সুস্থ না হওয়া, এসব কিছুই আমাদেরকে ধাবিত করেছে ধর্মীয় সচেতনতার দিকে। ধর্মীয় সচেতনতা আমাদেরকে শুধু আত্মার শান্তিই দেয় না, সাথে মানসিকভাবেও আমাদেরকে করে তুলে শক্তিশালী। ক্ষুদ্র এই জীবাণু আমাদের দেখিয়েছে সচেতন না হলে আমরা কতোটা অসহায় হতে পারি।
এ করোনাকালে সবাই ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে একজন অপরের বিপদে এগিয়ে এসেছে। হেরেছে বিদ্বেষ, জয় হয়েছে মানবিকতার। এ শিক্ষা শুধু এরকম বিপদের মাঝেই যেন সীমাবদ্ধ থেকে না যায়। সব সময় একজনের পাশে আরেকজনের থাকা প্রয়োজন। স্বার্থ ছাড়াই উপকার করার নাম মানবিকতা। থাকা প্রয়োজন কৃতজ্ঞতাবোধও।
দুনিয়ার করোনা ভাইরাসের আজাবটা পৃথিবীর মানব জাতিকে শিক্ষা দিয়েছে—ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি, ইয়া রাব্বানা ইয়া রাব্বানা। করোনা ভাইরাস থেকে আমরা কিছুটা না হলেও শিখতে পেরেছি যে, আর জীবনে কখনো কবিরা গুনাহ, ছগিরা গুনাহ করব না। মিথ্যা কথা বলব না, চুরি, ডাকাতি, খুন, সুদ, ঘুষ, হিংসা, চোগলখুরি, গিবত, দুর্নীতি করব না। করোনা ভাইরাসের প্রথম দিকে মানুষ খুবই ভয় পেয়ে মসজিদমুখী এবং আল্লাহমুখী হয়েছিল। পরে কিছু কিছু মানুষ করোনা ভাইরাসের মধ্যেও খারাপ কাজ করছে। আল্লাহর কাছে করোনা ভাইরাসের ভয়ে তাওবা করে, আবার করোনা ভাইরাস আপ-ডাউন করলে কেউ-বা হয়ে যায় শক্ত মনের।
এ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন যে, মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থির চিওরূপে, যখন বিপদ তাদের পাকড়াও করে সে হা-হুতাশ করে, আর যখন তার ওপর কল্যাণ আসে তখন সে হয় খুবই কৃপণ, তবে নামাজ আদায়কারী ব্যতীত। (সুরায়ে মায়ারিজ আয়াত ১৯, ২০)
কিছু কিছু মানুষ করোনা ভাইরাসের মধ্যে অপকর্ম করে তাদের অন্তরও কঠোর হয়ে গেল, এ বিষয়ে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন যে, আমি তাদের কে অভাব অনটন ও রোগব্যাধি দিয়ে পাকড়াও করে ছিলাম, যাতে তারা আমার নিকট কাকুতিমিনতি করে, অতঃপর তাদের নিকট যখন আমার আজাব এলো, তখন তারা কোনো কাকুতিমিনতি করল না? প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর কঠোর হয়ে গেল। (সুরা আনয়াম আয়াত ৪২, ৪৩)
করোনা আমাদের দেখালো- সংস্কৃতি, ধর্ম, পেশা, আর্থিক অবস্থা, খ্যাতি ইত্যাদির পরও আমরা সবাই সমান। করোনা আমাদের দেখিয়েছে যে, আমারা সবাই একে অপরের সঙ্গে দারুণভাবে সম্পৃক্ত। জগতের সব কিছুই একটি বন্ধনে আবদ্ধ।
সীমান্তরেখাগুলো আসলেই মিথ্যা। এগুলোর মূল্য কতো কম তা করোনা ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা ভালো করেই দেখেছি, সীমান্ত পাড়ি দিতে ভাইরাসের ভিসা, পাসপোর্ট কিছুরই প্রয়োজন হয় না।
করোনা-ক্রান্তি বিশ্ব-জীবনযাত্রার এমন কোনো স্তর নেই যাকে তার অশনি-বলয়ের স্পর্শে তছনছ করেনি, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক দুঃসহ সময় যা অনন্তকাল বারবার মনে করিয়ে দেবে এক ভুল প্রতিযোগিতার দৌড়ে তারা মেতে ছিল আর সেটা হলো শক্তি-প্রতিযোগিতা এবং একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের কৌশল প্রণয়ন। প্রকৃতি এখন তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিংবা বলা যায় মানুষ তার ভ্রান্ত ধারণার খেসারত দিচ্ছে।
করোনায় আমাদের মানসিকভাবেও শক্তিশালী হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনাকে জয় করার বড় হাতিয়ার হচ্ছে মানসিক শক্তি। ভেঙে পরলে চলবে না কোনোভাবেই। মনে সাহস রাখতে হবে। আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক, প্রিয়জনদের কথা ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে। তাদের পাশে থাকতে হবে এবং তাদেরও পাশে রাখতে হবে।এ সময়ে প্রিয়জনেরাই মনোবল বৃদ্ধি করে।
নিজের শক্তি,সাহস , মনোবল, ধৈয্য ও আস্থা বাড়াতে হবে। মানসিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতি অন্যের কাছে আরো আস্থা অর্জন করে তুলতে হবে ।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের আশা-ভরসার একমাত্র নিরপাদ আশ্রয়স্থল। তিনি সর্বাবস্থায় বান্দার জন্য সহায়। আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক রাকিবুজ্জামান আহমেদ।।