সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন মানুষ বিতর্কিত এবং আপত্তিকর মন্তব্য করে থাকেন। ইনিয়ে বিনিয়ে কেউ কেউ ধর্ষিতাকেই দোষী বলে প্রমাণ করতে চান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর কাছে তার নিজের ইজ্জত সব থেকে বেশি মূল্যবান। সবার কাছেই ইজ্জত তার জীবনের থেকেও মূল্যবান। এই মূল্যবান জিনিষটাও যদি জোর করে কেউ কেড়ে নেয় সেখানে আর কি বা থাকে? বর্তমানে ধর্ষণের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে তাতে মনে হয় ধর্ষণ এই দেশের চলমান কার্যক্রম হয়ে গেছে। দেশের সংবাদ কর্মীরাও নিয়মিত এসব সংবাদ প্রকাশ করতে করতে প্রায় ক্লান্ত।
কোন নারীই ইচ্ছাকৃত ভাবে ধর্ষিত হতে চায় না। তাহলে কেন সেই ধর্ষিতাকে আমরা দোষারোপ করব? আমাদের সমাজ কেন একটা নারীর নিরাপত্তা দিতে পারছে না? আমাদের ব্যর্থতা কোথায়? আমাদের মূল ব্যর্থতা আমাদের মানসিক অবনতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সারা দেশ থেকে গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছে। প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিতার চিকিৎসা দিতে হচ্ছে সেখানে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৫৪টি অভিযোগ রুজু হয়েছে। এর মধ্যে রাস্তা থেকে অপহরণ করে গাড়ির মধ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলাও রয়েছে বেশ কয়েকটি।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। তবে অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে।
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷
এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷
তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷
গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷
জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই যোগাযোগ করা যায়৷ কিন্তু এই ধরণের কোন ব্যবস্থাই আমাদের দেশে বিদ্যমান নেই।
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷ রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধগুলো বাড়িতেই হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে যুক্ত থাকেন পরিবার এবং আত্মীয়রাই। নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
রাহেবুল ইসলাম টিটুল লালমনিরহাট অনলাইন নিউজ।