দেশ উত্তাল। চারদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খুন ও হত্যার পৈশাচিক উল্লাস, আগুনের লেলিহান শিখা। সংগীতশিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তখন আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ২৭ মার্চ সকালে তিনি একটি ফনিক্স সাইকেল নিয়ে বের হন রাজধানীর রাস্তায়। ঘুরতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায়।
শিল্পীর ভাষ্যমতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পলাশী ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ, রোকেয়া হল ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। লাশ যে এত করুণ আর মর্মান্তিক হয়, এটা আমি ওই সকালের আগে টের পাইনি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমার একটা গানের সূত্রপাত ওই দৃশ্য থেকে। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’।
‘এই একটা লাইন তখন মাথায় আসে। আমি দেখছিলাম একটা ঘরে আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে, আর সেই ঘরে কোনো দরজা নেই। রয়েছে অসংখ্য জানালা। কিন্তু মা বের হতে দিচ্ছে না। আমি উদ্ভ্রান্তের মতো সাইকেল চালাতে চালাতে খুঁজতে থাকি মুক্তি। এত লাশের বোঝা কাঁধে নিয়ে কি করে সামনে এগোবে! মাথায় কাজ করছিল না কিছুই। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যুদ্ধে যাব। আমার কয়েকজন বন্ধু আর সজীব ভাই মিলে প্ল্যান ফিক্সড করে ফেললাম। সজীব ভাই বয়সে চার বছরের বড় বলে তাকে দলনেতা বানিয়ে শুরু হলো আমাদের যুদ্ধযাত্রা।
‘এক দুপুরের সিদ্ধান্তে আমরা ২৭ তারিখ সন্ধ্যার একটু আগে ছয়টি বিহারি বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করি। এরপর ক্যা¤প বানাই জিঞ্জিরায়। কিন্তু রাজাকারের এদেশীয় দোসররা আমাদের সন্ধান দিয়ে দেয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। ১১ দিনের মাথায় স্থান পরিবর্তন করে চলে যাই পটিয়া। এভাবেই চলতে থাকে আমার ও আমাদের যুদ্ধজীবন।’
২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন বুলবুল। সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘২ অক্টোবর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে। শহীদ বাতেন, শহীদ নজরুলসহ মোট বায়ান্ন জন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে ছিলাম। এর মধ্যে বিয়াল্লিশ জনকে আমার চোখের সামনে হত্যা করা হয়। আমাদের মৃত্যুও নিশ্চিত। এক রাতে আমরা চারজন জেল থেকে পালিয়ে নৌকার মাঝি সেজে ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু মাত্র এক দিনের ব্যবধানে আজিমপুরের বাসা থেকে আবার গ্রেপ্তার হই। এবার আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। সেকি বীভৎস দৃশ্য! এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মানুষের মৃতদেহ। সেখানেই আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
‘এরপর যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে আবিষ্কার করি রমনা থানায়। সেখানে মোট ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ওখান থেকে কখনো এক সপ্তাহ বা কখনো দুই সপ্তাহ পরপর সাতজন করে নিয়ে যাওয়া হতো রাজারবাগে। সেখানেই হত্যা করা হতো তাদের। আর আমরা বসে বসে মৃত্যুর জন্য দিন গুনতাম। ভাইয়ের সামনে ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া যে কতটা যন্ত্রণার, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এ রকমভাবে আমরা ১৪ জন অবশিষ্ট ছিলাম।
‘১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর, মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে আমাদের উদ্ধার করেন। ১৭ ডিসেম্বরের বাংলাদেশ দেখে আমি বুক ভরে ‘মা’ বলে ডেকে উঠেছিলাম। আর আমার সেই ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানটার পরের লাইন ওখান থেকে বের হতে হতে মাথায় এসেছিল।’