রাহেবুল ইসলাম টিটুল লালমনিরহাট ।
রংপুর বিভাগের মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বরাবরই একটু বাড়তি প্রত্যাশা করে থাকেন। এবার প্রধানমন্ত্রীর জনসভা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এ অঞ্চলের মানুষ নির্বাচনের আগে তাদের দীর্ঘদিনের তিস্তার সমস্যা সমাধান হবে এমন আশায় বুঁক বেঁধেছেন। এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তা নদী নিয়ে সরকারের তিস্তা পরিকল্পনা।
উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন তিস্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকার পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এ নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এখন ‘সুখবর’ ঘোষণার অপেক্ষায়। এসব নিয়ে বিভাগজুড়ে চলছে নানা জল্পনা। তারা মনে করছেন, শুধুই তিস্তা সমস্যা সমাধানই নয়, ঘোষণায় যোগাযোগ, শিক্ষা, কৃষির মতো ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জেলার মানুষের দাবির প্রতি সমর্থন জানাবেন প্রধানমন্ত্রী।
‘প্রাণের দাবি’ তিস্তা
বর্ষায় উজানের ঢল এবং নদী ভাঙনে নদীতীরবর্তি এসব এলাকা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি শুস্ক মৌসুমে পানির অভাবে নদী থেকে সেচের সুবিধা পাওয়া যায় না। ফলে এ নদী এখন রংপুর অঞ্চলের অভিশাপে পরিণত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে সোচ্চার এসব মানুষের দাবি, নদী খননের মাধ্যমে বর্ষার পানি ধরে রাখা, বাঁধ নির্মাণসহ নানা কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা নিয়ে মহাপরিকল্পনা নেওয়ার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তিস্তা নদীতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে চীন সহায়তা দিতে চায়। এই সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারত রুষ্ট হতে পারে। ভ‚রাজনৈতিক এসব জটিল বাস্তবতা থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের উচিত নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। এই মহাপরিকল্পনা এমন হতে হবে যাতে নদী, প্রাণ-প্রকৃতি, কৃষি সব কিছুরই কল্যাণ হয়। এর কোনোটিরই ক্ষতি করে তিস্তার উন্নয়ন হবে না।
তিস্তাতীরবর্তি এসব অঞ্চলের মানুষ এখন যতটা না পানির ন্যায্যহিস্যা দাবি করেন এর চেয়েও বেশি দাবি করছেন তিস্তা নিয়ে ‘মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চর বৈরাতী গ্রামের বানেকা বেগম বলেন, ‘আমরা তিস্তাপাড়ের মানুষ বন্যায়-খরায় শ্যাষ। হুনছি প্রধানমন্ত্রী রংপুর আসতাছে। তার কাছে আমরা আর কিছুই চাই না, শুধু নদীডার একটা ব্যবস্থা চাই।’
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান বলেন, শেখ হাসিনা রংপুরের পুত্রবধূ। ২০১১-২০১২ সালে ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি না হওয়ায় তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যেমন নদী অববাহিকার এক কোটি মানুষ উপকৃত হবে। তেমনি আগামী নির্বাচনে তিস্তাপারের ১৪ উপজেলার ১১টি সংসদীয় আসনের অন্তত ৩০ লাখ ভোটার প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা করে।
নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘রংপুর বিভাগের ২ কোটি মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা। তারা ভাঙনের তথা বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে চায়। আসন্ন রংপুর সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেবেন এমনটাই আমরা আশা করি।’
‘ট্রেনের অপেক্ষা আর কত?’
ভৌগলিকভাবে লম্বাকৃতির জেলা লালমনিরহাট। এর একপাশে ভারতীয় সীমান্ত, অন্যদিকে তিস্তা নদী। জেলা শহরসহ সদর উপজেলাকে একপাশে রেখে পরপর আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলা। পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে ভারত হয়ে নেপাল-ভুটান যুক্ত। রেলওয়ের বিভাগীয় শহর লালমনিরহাট থেকে ঢাকায় চলাচল করে একমাত্র আন্তঃনগর ট্রেন ‘লালমনি এক্সপ্রেস’। সেই ট্রেনে চড়তে সদর বাদে বাকি চার উপজেলার মানুষকে মাড়াতে হয় দীর্ঘপথ। ফলে এই উপজেলাগুলোর মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি বুড়িমারী-ঢাকা আন্তনগর ট্রেনের।
২০১১ সালে পাটগ্রাম সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুড়িমারী-ঢাকা পথে আন্তনগর ট্রেন চালুর আশ্বাস দিয়েছিলেন। দীর্ঘসময় পর বর্তমান সরকারের রেলমন্ত্রী দুবার লালমনিরহাট সফরে এসে ট্রেনটি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ফলে এবার প্রধানমন্ত্রী রংপুর সফরের সময় ট্রেনটি চালুর ঘোষণা দেবেন-এমন আশা করছেন এ জেলার মানুষ।
লালমনিরহাট সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহসভাপতি আবু হাসনাত রানা বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে বুড়িমারী-ঢাকা আন্তনগর ট্রেনের দাবি তুলছে লাখো মানুষ। আর কতদিন থাকতে হবে ট্রেনটির অপেক্ষা? এ জেলার মানুষ চায় এবার প্রধানমন্ত্রী ট্রেনটি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করুক।’ ট্রেনের পাশাপাশি সড়ক উন্নয়নসহ আরও কয়েকটি দাবি তুলছেন লালমনিরহাটের মানুষ।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের রংপুর সফরকে ঘিরে জেলা থেকে বিভিন্ন দাবি পূরণের কথা উঠেছে।
লালমনিরহাট শহরের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিমানবন্দরটি আয়তনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। কিন্তু এই বন্দরে বিমান ওঠানামা করে না। কয়েকবছর আগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এই বিমানবন্দরকে ঘিরে বিমান বাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্থাপিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়’। ফলে এই জেলার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দাবি তুলে আসছেন এই বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইট পরিচালনার। পরিত্যক্ত বিমানবন্দরও পুনরায় চালুর দাবি সেখানকার মানুষের।