রাহেবুল ইসলাম টিটুল,লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ
ছোলেমান গনি। তিনি এবছর প্রায় ২ একর জমিতে ধান চাষ করেছেন। কিন্তু ধান ঘরে তোলার পর তিনি পড়েছেন বিপাকে। তার উৎপাদন খরচই উঠেনি। অথচ দোন প্রতি তার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন,সরকার সবার খবর নেয়,অথচ কৃষকের খরব নেয় না। তিনি আরো বলেন ধান চাষ করমু না আর বিপদে পড়মু নাহামারগুলার খবর কায় নিবে? শুধু ছোলেমান গনিই নয়,এরকম আহাজারী জেলার কৃষকদের মাঝে বিরাজ করছে।
ছোলেমান গনির বাড়ী লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাশিরাম গ্রামে।
লালমনিরহাটে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। খেতে ধান পাকলেও কাটার শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। তার ওপর বাজারে ধানের দাম কম। এতে সম্পূর্ণ হতাশ কৃষকেরা। অনেকে ভবিষ্যতে আর ধানই আবাদ করতে চান না।
কৃষকদের অভিযোগ, সরকারের আপদকালীন চাল কেনার সিদ্ধান্তে মূলত লাভবান হচ্ছেন চালকল মালিক ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। আর বিঘা প্রতি কৃষকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
জেলায় এবার প্রতি মণ ১ হাজার ৪৪০ টাকা দরে ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং প্রতি মণ ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ১ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। বিপুল পরিমাণ এই ধান-চাল মূলত কেনা হবে মিল মালিকদের থেকে।
স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় গত বছরের বোরো আবাদ হয়েছিল ৪৯ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। এবার তা কমে ৪৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩ হাজার হেক্টরের চেয়ে বেশি ধান আবাদ হয়েছে। আবাদকৃত জমির মধ্যে বিআর ২৮ ও বিআর ২৯ ধানের চাষাবাদ বেশি।
কৃষি অফিসের সহযোগিতায় বোরো ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার। ইতোমধ্যে তিস্তায় এলাকার ৭০ ভাগ ও সমতল এলাকার ৩০ ভাগ ফসলি জমির ধান কাটা হয়েছে। তবে ধান উৎপাদনে কলচার্জ, শ্রমিক মজুরি, সার ও কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে।
কৃষকরা বলছেন, উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারে ধানের দর কম। ফলে লোকসান দিয়েই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। সবমিলিয়ে মুখে হাসি নেই খেটে খাওয়া এসব মেহনতী মানুষের। আর তাই কৃষিকাজে আস্থা হরিয়ে ভবিষ্যতে আর ধান রোপণ করবেন না বলেও জানালেন অনেকে।
সুকানদিঘী এলাকার কৃষক আব্দুর রশীদ বলেন, তিনি ৪ বিঘা জমিতে এবছর বোরো ধানের আবাদ করেছেন। ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। ধান কাটার জন্য শ্রমিককে দৈনিক মজুরি দিতে হয়েছে ৭০০-৭৫০ টাকা। আর প্রতিমণ ধানের দাম ৫১০-৫৩০ টাকা। তাও আবার কিনতে চায় না ব্যবসায়ীরা। এবার ধান চাষ করে তার অনেক লোকসান হয়েছে।
কৃষক রমজান আলী বলেন, ’বর্তমানে সরকার ধানের যে বাজার মূল্য দিছে আগামী বছরে আর আবাদ করিম না (করব না)। এ মূল্যে হামার লাভ হবার নয়। দর না বাড়াইলে (দাম না বাড়ালে) আগামীতে আর ধান চাষ কেউ করিম না।’
মফিজুল ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘এক বিঘা জমির ধান করতে খরচ অয় ১০ হাজার টেহা (টাকা)। কিন্তু বাজারো নিয়া গিয়া এই এক বিঘা জমির ধানের দাম ৭ হাজার টেহার বেশি পাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর ঋণ কইরা ধান করছি, এরপরও লোকসান। সামনেরবার এই ধান আর করতাম (করব) না।’
এভাবে শুধু কৃষক মফিজুল ইসলাম নয় এ বছর লোকসানের মুখে পড়ে কৃষি কাজে আস্থা হারাচ্ছেন এ অঞ্চলের বহু কৃষক। তাই লোকসানের মুখ থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে ধানের বাজার মূল্য বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন লালমনিরহাটের কৃষকরা।
এদিকে সরকারিভাবে নির্ধারিত বাজারমূল্য অনুসারে খাদ্য বিভাগ ধান সংগ্রহ শুরু করলে ধানের বাজার মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষকরা লাভবান হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিদু ভুষণ রায় বলেন, ‘এ বছর কৃষি অফিসের সহযোগিতায় বাম্পার ফলন হয়েছে। যার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪৮ হাজার ১৫০ হেক্টর। সরকারের নির্ধারিত বাজার মূল্যে খাদ্য বিভাগ ধান সংগ্রহ শুরু করলে বাজারে ধানের মূল্য বাড়বে এবং কৃষকরাও লাভবান হবেন।’